ব্রজেন্দ্রকুমার দের অবদান এবং কেন তিনি পালাসম্রাট?

Photo of author

By কৌশিক

যাত্রাপালা / থিয়েটার

পালাসম্রাট ব্রজেন্দ্রকুমার দের কথা জানতে গেলে তাঁর জন্মের আগে থেকেই জানতে হবে তবেই বুঝতে পারবেন কেন তিনি পালাসম্রাট ,

ব্রজেন্দ্রকুমার দের (Brajendra kumar dey)জন্মের আগের কথা

একটা সময় ছিল যখন যাত্রাপালা এবং যাত্রা শিল্পীদের একটু অন্য চোখে দেখতো আমাদের সমাজ আর সেই সপর্কে একটা গল্প কথা প্রচলিত আছে যাত্রার ইতিহাসের পাতায়। রাত্রির শেষ প্রহরে এক গৃহকর্তা আধা ঘুমন্ত অবস্থায় নিজের বাড়িতে শুয়ে আছেন , হটাৎ শুনতে পেলেন তার বাড়ির পাশ দিয়ে কারা যেন গল্প করতে করতে পায়ে হেঁটে যাচ্ছে , তিনি আওয়াজ দিলেন — কে যাই ? উত্তর এলো – আজ্ঞে আমরা যাত্রা দলের লোক – বাড়ি ফিরছি। একথা শুনে গৃহকর্তা বলে উঠলেন ওহ আমি ভাবলাম মানুষ বুঝি , হেহে এই ছিল অবস্থা! যাত্রার সাথে যারা যুক্ত তাদের মানুষ ভাবতেই রাজি ছিলোনা তৎকালীন সমাজ।

সেইসময় যাত্রায় যোগ দেওয়া মানে, নামমাত্র পারিশ্রমিক , দু’বেলা পেটচুক্তিতে খাওয়া তাও সবার খাবার সমান ছিলোনা , যাত্রাদলের নায়কের জন্য বরাদ্দ থাকতো মাছের মাথা আর বাকিরা সবাই মাছের অন্য অংশ , আর যাত্রার আসর কাছে হলে পায়ে হেঁটে, নচেত্ গরুর গাড়ি বা নৌকায় যাতায়াত করতে হতো ৷

বৈদ্যুতিন আলো বা মাইক তো ছিলইনা , এমনকি যাত্রার আসর পাতা হতো মাটিতেই, দড়ি বা বাঁশ দিয়ে ঘিরে, আর সেই আসরের চারপাশ ঘিরে দর্শকরা বসতেন।

যাত্রাপালার গল্পে মহিলা চরিত্র থাকতো কিন্তু মঞ্চে মহিলা থাকতো না , মহিলা চরিত্র গুলিতে অভিনয় করতেন পুরুষ রানীরা। যেমন চপল ভাদুড়ী বা চপল রানী নারী চরিত্রে অভিনয় করতেন, তার যাত্রা জীবনের ভিডিও লিংক ডেসক্রিপশন এ রইলো দেখতে পারেন।

তখন যাত্রাপালা মানে ছিল ৫ থেকে ৮ ঘন্টা, আসর ভাঙতে রাত গড়িয়ে ভোর হয়ে যেত ! এক-একজন দক্ষ অভিনেতার প্রতিটি সংলাপ কমপক্ষে দেড় থেকে দুই -পাতা ! পালার শুরুতে এমনকী পালার যেকোনো মুহূর্তে বারবার ধৈর্যচ্যুতি ঘটিয়ে গান আর নাচ ৷ এমনকী মৃত্যু -পথযাত্রীও গান গাইছেন ! সব মিলিয়ে কমপক্ষে গোটা চল্লিশ গান থাকতো !

ব্রজেন্দ্রকুমারের (Brajendra kumar) জন্মের পরের কথা

এরই মাঝে ১৯০৭ সালের পহেলা ফেব্রুয়ারী তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের পূর্ববঙ্গ অধুনা বাংলাদেশের মাদারীপুর জেলার অন্তর্গত গয়ঘর গঙ্গানগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করলেন যাত্রা শিল্পের অন্যতম উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক ব্রজেন্দ্রকুমার দে। পিতা— হরিকিশোর দে ছিলেন স্বল্প শিক্ষিত। চাকরি করতেন কলকাতায়। মা ক্ষীরোদাসুন্দরী দেবীও ছিলেন অল্প শিক্ষিতা।

শৈশব থেকেই সংসারে ছিল অভাব তাদের নিত্যসঙ্গী। অভাবের চোখরাঙানি কে তোয়াক্কা না করেই তিনি পড়াশোনা করতে লাগলেন , ১৯২৯- সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এম. এ. এবং ১৯৩৭-এ শিক্ষকতার প্রশিক্ষণ নিয়ে বি.টি পাশ করলেন । এরপর ১৯৩০ থেকে ১৯৬৯ পর্যন্ত দুই বাংলার বিভিন্ন বিদ্যালয়ে দক্ষতার সঙ্গে শিক্ষক ও প্রধান শিক্ষক হিসেবে শিক্ষকতা করেছেন তাই তিনি পরিচিত ছিলেন “মাস্টারমশাই” নামে।

পূর্ববঙ্গে থাকাকালীন ব্রজেন্দ্র কুমার দে লিখেছেন সৌখিন যাত্রাপালা। পাশাপাশি অভিনয় ও নির্দেশনাও করেছেন । পালাকার ব্রজেন্দ্র কুমার দে ৫ থেকে আট ঘন্টার যাত্রাপালাকে কমিয়ে তিন ঘন্টায় নিয়ে আসেন। দেড় থেকে দুপাতা লম্বা সংলাপ এর বদলে তিনি ছোট ছোট সংলাপ তৈরি করেন। এছাড়া যাত্রাপালায় অশ্লীল শব্দ প্রয়োগের তিনি ছিলেন ঘোর বিরোধী। যাত্রাপালার ভাষা বদলে দেন তিনি। যাত্রা দলে যোগদানের কিছুদিনের মধ্যেই ব্রজেন্দ্রকুমার প্রমাণ করে দিয়েছিলেন তিনি যাত্রার জন্যই জন্মেছেন ।

‘ব্রজনাভ’ এবং ‘চাঁদের মেয়ে’ এই দুই পালার মধ্য দিয়ে তাঁর জয়যাত্রার শুরু, সেই জয়যাত্রার ধারাকে ব্রজেন্দ্রকুমার বহমান রেখেছিলেন আজীবন।

পরবর্তীকালে পেশাদার পালাকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবার পর আর নির্দেশনার কাজ আর করেন নি।৷ যাত্রাপালার প্রযোজনায় এতদিন প্রাধান্য দেওয়া হতো পরিচালক ও দক্ষ অভিনেতাদের , তা সরিয়ে প্রতিষ্ঠা পেলো যাত্রাপালায় পালাকারের প্রাধান্য ৷ প্রায় একাই বদলে দিলেন যাত্রাকে ৷ তাতে বদলে গেল প্রযোজনা পরিবেশনার ঢঙও৷ বৈপ্লবিক পরিবর্তন হলো যাত্রাপালায় এবং শুরু হল যাত্রায় ব্রজেন্দ্র -যুগ ৷

দুর্ভিক্ষের প্রেক্ষাপটে মহাজন ও চোরাকারবারীদের দায়ী করে পালাকার ব্রজেন্দ্র কুমার দে লিখেছিলেন “আকালের দেশ।” এরপরেই ক্ষেপে যায় ব‍্যবসায়ীর দল। আর তার জেরে শেষ পর্যন্ত পূর্ববঙ্গের গ্রামের জন্মভিটে ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় চলে আসেন পালাকার ব্রজেন্দ্র কুমার দে।

কলকাতায় শিক্ষক ও নট-নাট‍্যকার যোগেশচন্দ্র চৌধুরীর সাহচর্যে এসেছিলেন ব্রজেন্দ্র কুমার দে। কলকাতায় এটিই তাঁর একমাত্র বুদ্ধিজীবী সঙ্গ। যদিও ওপার বাংলায় থাকার সময় (১৯৩৭-৪৪) কম‍্যুনিষ্ট দলের সংস্পর্শে এসেছিলেন, কিন্তু কলকাতায় এসে আর যোগাযোগ রাখেননি।

উচ্চশিক্ষিত এবং স্কুলশিক্ষক হয়েও সুদীর্ঘ ৫০টি বছর ধরে শুধু যাত্রাপালাই লিখে গেছেন। তিনি যাত্রার আধার এবং আধেয় পরিবর্তনের সাথেসাথে যাত্রার সু-সংস্কৃত ও মার্জিত রূপ প্রদান করে যাত্রাশিল্পকে শিক্ষিত মহলের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলেছিলেন। আমাদের সমাজে যাত্রাশিল্প তথা যাত্রাশিল্পীদের প্রতি সম্মান প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাই তিনি শুধুমাত্র পালাসম্রাট বা ছিলেন তা নয়, তিনি ছিলেন লোকনাট্যগুরু এবং বাংলার যাত্রাপালা ও লোকাভিনয়ের ইতিহাসে এক নবযুগের প্রবর্ত্তক।

১৯৫৯ সালে যাত্রাজগতে আলোড়ন ফেলে দিল ব্রজেন্দ্রকুমার দের সোনাই দীঘি পালা। এই পালার প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন যাত্রা সম্রাজ্ঞী জোৎস্না দত্ত। সোনাইয়ের চরিত্রে জ্যোৎস্না দত্তের গান ও অভিনয় সাড়া ফেলে দিয়েছিলো সারা বাংলায় । বছরের পর বছর মানুষ আত্মহারা হয়ে একই পালা দেখতে লাগলেন। আসরে দর্শকদের স্থান দেওয়া যেত না এতো মানুষের ঢল নামতো সোনাই দীঘি পালা দেখতে। একই আসরে পরপর তিন রাত্রি ব্যাপী সোনাই দীঘি (Sonai dighi)পালা মঞ্চস্থ হয়েছিল । তাই যাত্রার ইতিহাসে অমর হয়ে রইল সোনাই দীঘি পালা ।

১৯৭৩-এ তিনি লিখলেন যুগান্তকারী পালা “নটী বিনোদনী (noti binodini)” , এই পালায় বিনোদিনীর ভূমিকায় অভিনয় করে গেছেন যাত্রালক্ষ্মী বীনা দাশগুপ্ত। গিরীশ ঘোষের ভূমিকায় অভিনয় করে গেছেন অরুণ দাশগুপ্ত। যাত্রাপালাটি পরিবেশনা করেছিলেন নট্ট কোম্পানি(Notto company)।পশ্চিমবঙ্গ যাত্রা উৎসবে শ্রেষ্ঠ যাত্রাপালা হিসেবে পুরস্কৃত হয় “নটী বিনোদনী (noti binodini)” ।

১৯৭৪ সালে ব্রজেন্দ্রকুমার দে লিখলেন ‘বিদ্রোহী নজরুল (bidrohi najrul)’। পালাটি মঞ্চস্থ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হল প্রবল বিতর্ক। ‘বিদ্রোহী নজরুল’ পালায় কবি মোহিতলাল মজুমদারের চরিত্রটি যেভাবে চিত্রিত হয়েছিল তা নিয়ে আপত্তি তোলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক অরুণ মুখোপাধ্যায়। আনন্দবাজার পত্রিকার মাধ্যমে ব্রজেন্দ্রকুমারকে তীব্র আক্রমণ করলেন তিনি। ‘যাত্রায় মোহিতলাল ‘ শীর্ষক লেখার মধ্য দিয়ে অরুণবাবু অভিযোগ করেন— ‘মোহিতলাল মজুমদার চরিত্রটিকে এই পালায় হাস্যকর চরিত্র রূপে উপস্থাপন করা হয়েছে।’ এই পালাটি নিয়ে শেষ পর্যন্ত আদালতের দ্বারস্থ হন মোহিতলাল মহাশয়ের পুত্র মৃন্ময় মজুমদার, যদিও মামলার নিষ্পত্তি হওয়ার আগেই মৃত্যু হয় ব্রজেন্দ্রকুমারের।

১৯৭৫-এ জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে বক্তিতা দিয়েছিলেন তিনি । ইন্দিরা গান্ধীকে কেন্দ্র করে এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায় এবং সুপ্রিম কোর্টের রায়কে উপজীব্য করে তাঁর লেখা যাত্রাপালা ‘কাজির বিচার’ ও ‘নন্দকুমারের ফাঁসি যাত্রা জগতে এক যুগান্তকারী ঘটনা।

১৯৩০ খ্রিস্টাব্দ হতে ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দুই বাংলার বিভিন্ন বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসাবে দক্ষতার সঙ্গে কাজ করেছেন । বিংশ শতকে বাংলানাটকের মূলস্থপতি যেমন বিজন ভট্টাচার্য তেমনই যাত্রাপালার প্রধানস্রস্টা ব্রজেন্দ্রকুমার দে। প্রখ্যাত পালাকার ভোলানাথ কাব্যশাস্ত্রীর উত্তরসূরি তিনি। নাট্যকার যোগেশচন্দ্র চৌধুরীর ছাত্র তিনি যাত্রানাট্যে নতুন আঙ্গিকসহ আধুনিকতার প্রবর্তন করেছিলেন। পৌরাণিক, ঐতিহাসিক, কাল্পনিক, সামাজিক, জীবনীমূলক, দেশাত্মবোধক, গীতিকা আশ্রিত পালা-সব মিলিয়ে দেড়শর বেশি পালা রচনা করে তিনি যাত্রাপালার(Jatra Pala) উৎকর্ষ সাধন করেছেন।

তাঁর “সোনাই দীঘি (sonai dighi)” যাত্রাপালার (jatrapala) সংলাপ একসময় যাত্রামোদী দর্শক-শ্রোতাদের মুখে মুখে ফিরতো। সিরিয়ালের যুগে সেসব এখন গল্পকথা। পরবর্তীকালে ত্রিদিব ঘোষ এর পরিচালনায় ও গিরিশ ঘোষ রূপে এবং বিনোদিনীর ভূমিকায় তাপসী রায়চৌধুরী‘ কে নিয়ে নটি বিনোদিনী’ পালাকে আবার পরিচালনা করে বিশাল সাফল্য লাভ করেন।

১৯৭৬ সালের ১২ই মার্চ, আমাদের ছেড়ে অমৃতলোকে চলে যান তিনি কিন্তু বাঙালির মননে চিন্তনে তিনি রয়ে গেছেন তাঁর সৃষ্টির মাধ্যমে , বলা হয় বাংলা মঞ্চাভিনয়ের ক্ষেত্রে গিরীশচন্দ্র ঘোষের যে স্থান,বাংলার একালের যাত্রাভিনয়ের ক্ষেত্রে ব্রজেন্দ্রকুার দে সেই স্থানের অধিকারী।

যদি কোনো ভুলত্রুটি হয়ে থাকে নিজ গুনে মার্জনা করবেন ,ভালো লাগলে আপনার মূল্যবান মতামত কমেন্ট এ জানাবেন।।। এরকম আরো অনেক কথা জানতে আমাদের ওয়েবসাইট এ নজর রাখুন এবং FacebookYoutube এ যুক্ত হন।

আরো বিনোদন

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.